আলজাজিরা কেন সৌদি জোটের চক্ষুশূল

আরব বিশ্বের মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে আলজাজিরা নিজেকে নতুন এক চূড়ায় নিয়ে গেছে বেশ আগেই। ভেঙে ফেলেছে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের কর্তৃত্বও। মধ্যযুগের পর সম্ভবত প্রথম তাদের হাত ধরেই পাশ্চাত্যের মানুষ প্রাচ্যের কথা শুনেছে প্রাচ্যের মানুষের মুখে। তবে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আলজাজিরা এখন বন্ধের হুমকিতে।

সৌদি আবর, আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর গত মাসে কাতারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। অভিযোগ তুলেছে, দেশটি সন্ত্রাসবাদে মদদ দিচ্ছে আর তাতে ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। কাতারকে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে ১৩ দফা দাবি চাপিয়ে বলছে ৩ জুলাইয়ের মধ্যে সেগুলো মেনে নিতে, নইলে ভয়াবহ পরিণতি…। ১৩ দফা শর্তের প্রথমটিই হচ্ছে আলজাজিরা বন্ধ করতে হবে। দোহা যদি তা মেনে নেয় (না মানার ইঙ্গিতই দেখা যাচ্ছে), তবে দেশটি তার সার্বভৌমত্ব হারাবে, করদ রাজ্যে পরিণত হবে সৌদি ও আমিরাতের।

শেষ পর্যন্ত যা-ই ঘটুক না কেন, এ পরিস্থিতিকে আলজাজিরার সাফল্য হিসেবেই মেনে নিতে হবে। প্রতিষ্ঠার ২১ বছর পরও তারা মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল। খুব কম গণমাধ্যমই নিজেকে এতটা অনুপ্রেরণাদায়ী বলে দাবি করতে পারে। আলজাজিরা আবর গণমাধ্যমের খোল-নলচে পাল্টে দিয়েছে তো বটেই, ২০১০ সালে গোটা আরবজুড়ে সত্যিকারের রাজনৈতিক বিপ্লব জাগাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যমটি। আলজাজিরার আগে আরব টেলিভিশন স্টেশনগুলো ছিল ক্ষমতাসীনদের দিনলিপি প্রদর্শনের মাধ্যম। আলজাজিরা সম্প্রচারে এসেই সেগুলোকে এককথায় উড়িয়ে দেয়। যাদের কণ্ঠস্বর কখনও শোনা যেত না, তাদের মুখপত্র বনে যায় গণমাধ্যমটি। হোক সে ইসরাইলি কিংবা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, অথবা চেচেন বিদ্রোহী, কিংবা ওসামা বিন লাদেন।

এমনও হয়েছে, ড. ফয়সাল আল কাশেমের ‘দ্য অপোজিট ডিরেকশন’ শো’র সময় শহরগুলো থাকত নিঝুম, সবার চোখ টিভি পর্দায়। ইরাকে ১৯৯৮ সালের ডেজার্ট ফক্স অপারেশনের কভারেজ, ৯/১১ পরবর্তী ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকারসহ অসংখ্য স্কুপ স্টেশনটিকে বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে। এমনকি আফগানিস্তানে মার্কিন জোটের অবরোধের সময় কয়েক সপ্তাহের জন্য আলজাজিরাই হয়ে উঠেছিল বিশ্বের নির্ভরযোগ্য নিউজ এজেন্সি। কারণ আফগানিস্তানে শুধু তাদেরই উপস্থিতি ছিল। আরব চ্যানেলগুলোর মধ্যে আলজাজিরা প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা শুরু করে। টকশোগুলোয় হাজির করে নতুন নতুন মুখ, যাদের আগে দেখা যেত না। আত্মঘাতী হামলা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিতর্কিত এমন অনেক বিষয়ই দারুণভাবে তুলে আনে তারা।

এগুলো সবই সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ট্যাবু ভেঙে ফেলে এবং ওই অঞ্চলে সাংবাদিকতার নতুন মান বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসে। গণমাধ্যমটি আরব বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো ধারণার প্রবর্তন ঘটায় এবং বাক-স্বাধীনতার সীমানা আরও প্রশস্ত করে। আলজাজিরা সম্প্রচারিত বিষয়গুলো ওই অঞ্চলের সরকারগুলোকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়। ওমান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের সঙ্গে কাতারের নিষ্পত্তি-অযোগ্য কূটনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়। আলজাজিরার কণ্ঠরোধে হেন কোনো উপায় নেই যার প্রয়োগ হয়নি। সাংবাদিক গ্রেফতার, ব্যুরো অফিস বন্ধ করে দেয়া, একাধিক মামলা, কার্যালয়ে বোমা হামলা চালিয়ে সাংবাদিক হত্যা- বাদ যায়নি কোনো কিছুই। শেষ পর্যন্ত আলজাজিরার অস্ত্রেই তাকে খতমের প্রত্যাশা থেকে ২০০৩ সালে সৌদি সরকার চালু করে আল অ্যারাবিয়া টিভি।

তবে কাতার ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে বৈরিতার একমাত্র কারণ আলজাজিরা নয়। সৌদি ও কাতার বিশ্বের দুটি ওয়াহাবি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও দেশ দুটির মধ্যে ঐতিহাসিক ও মতাদর্শগত বেশ পার্থক্য রয়েছে। সৌদি জোটের ১৩ দফায় আলজাজিরা রয়েছে কারণ এটা কাতারের শক্তিমত্তার প্রতীক এবং তাদের নীতিগত অবস্থানের প্রকাশ। কিন্তু এর বাইরেও আরও গভীর এক কারণ আছে। এটা বুঝতে হলে পশ্চিমাদের জানতে হবে আলজাজিরার আদল দুটি- একটি ইংরেজি, আরেকটি আরবি। এর আরবি সংস্করণই কাতারের প্রতিবেশীদের গাত্রদাহের প্রকৃত কারণ। আলজাজিরার ইংরেজি সংস্করণের সঙ্গে পশ্চিমা দর্শকরা বেশ পরিচিত। মানসম্মত প্রতিবেদন, দৃষ্টিনন্দন ডকুমেন্টারি বিবিসি, সিএনএন, ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর, রাশিয়া টুডের মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে একে।

অনেক বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেন যে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিয়ে আলজাজিরা যে ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করে তার মান বিবিসি, সিএনএনেরও চেয়ে ভালো। আলজাজিরা নতুন রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচায় ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো উপস্থাপন করায় তা কাতারের প্রতিবেশীদের অস্বস্তিতে ফেলেছে। আর সবচেয়ে বেশি ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে গণমাধ্যমটির একটি মনোভাবে। তা হল- এ অঞ্চলে একদিন না একদিন হয় বিপ্লব বা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড ও হামাসের মতো রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসবে বলে মনে করে আলজাজিরা। এ বিষয়ে চ্যানেলটির নিজস্ব মনোভাব রয়েছে, যেটা আবার কাতারি নেতৃত্বেরও ধারণা। যেহেতু বিষয়টি ইসরাইল ও পশ্চিমা অনেক দেশের জন্যই উদ্বেগজনক, সে কারণেই আলজাজিরা বন্ধের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে সৌদি জোট। শঙ্কাটা একেবারে অমূলক নয়।

যে গুটিকয়েক সুন্নি আরব দেশে নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশেই জিতেছে ইসলামী দলগুলো। যদিও তাদের ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি বা হটিয়ে দেয়া হয়েছে দ্রুতই। একদিন ফের তারা ক্ষমতায় আসবে কাতারের এই বিশ্বাসকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু কাতারের প্রতিবেশীদের জন্য এটা অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্ন। কাতারের বিরুদ্ধাচারী আরব দেশগুলোর ক্ষমতাসীনরা জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে উৎখাত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে এবং সে শূন্যস্থান যে ইসলামী দলগুলো পূরণ করবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত তারা। সুতরাং আলজাজিরায় এ দলগুলোর বৈধ অংশগ্রহণ তাদের অস্তিত্বের জন্য স্পষ্টত ঝুঁকি। আরব জনগণ তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনির্বাচিত সরকারগুলোর ওপর ক্ষুব্ধ এবং ভবিষ্যতে বিকল্প কিছুর জন্যও প্রস্তুত। উদারপন্থী কিংবা ইসলামন্থী সুন্নি আরবদের একটি বড় অংশ আলজাজিরার গণতান্ত্রিক, ইসলামী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুপ্রেরণাদায়ী মনে করে।

গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিউ মাইলসের নিবন্ধ

অনুবাদঃ সাইফুল ইসলাম খান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.