বৃটেনে ১১ লাখ অবৈধ অভিবাসীর চরম দুর্দিন

ঘরে বাইরে আশ্রয়
নেই কোথাওghor

তাইছির মাহমুদ :: একের পর এক নতুন আইন। ঠেকাতে হবে ইমিগ্রান্টস। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর কনজার্ভেটিভ সরকার যেনো ইমিগ্রান্টস বিতাড়নে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অভিবাসী কমিউনিটি যেনো সরকারের জন্য বিষফোড়া। এবার আর শুধু রেস্টুরেন্ট কিংবা দোকান পাটেই নয়, গ্রেফতার অভিযান চালানো হবে খোলা আকাশের নিচেও। ক্লিনিং কোম্পানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিলডিং সাইট এবং কেয়ার হোমসেও। দিনে-রাতে, সপ্তাহে সাত দিন। যেখানে অবৈধ ইমিগ্রান্টস সেখানেই পুলিশি অভিযান। কোথাও কোথাও ইউকেবিএ অফিসারদের সাহস যোগাতে অভিযানে যোগ দিচ্ছেন ইমিগ্রেশন মিনিস্টার, হোম সেক্রেটারি এমনকি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীও।

গত সপ্তাহে এমন কঠোরতার কথা জানিয়েছেন হোম মিনিস্টার জেমস ব্রোকেনশায়ার। অবস্থাদৃশ্যে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে সরকারের প্রধান কাজ বৃটেনকে অবৈধ অভিবাসীমুক্ত করা। ৬ কোটি ৫৫ লাখ মানুষের এই দেশে মাত্র ১১ লাখ অবৈধ অভিবাসী যেনো সরকারের জন্য মস্তবড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওরা সরকারী কোনো বেনিফিট পায়না। হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে কোনো মতে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে।

অভিবাসীরা যাবে কোথায়? গেলো সপ্তাহে আইন করা হলো অবৈধদের ঘরভাড়া দেয়া যাবে, থাকার জায়গা দেয়া যাবে না। অর্থাৎ সরকার তাদের হাঁটে ঘাটে ভাতে মারতে চায়। কোথায় মানবাধিকার? রাতে একটু মাথা গোজার ঠাই দেয়াও কি অপরাধ?

ওরাও তো রক্তে মাংসে মানুষ। মাতৃভূমি ছেড়ে সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপারে পাড়ি দিয়েছে কি মনের সুখে? নাহ, নিজদেশে জীবনের চরম অনিশ্চয়তায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাড়ি দিয়েছে স্বপ্ন শহর লন্ডনে। যেখানে পাউন্ড উড়ে। গাছে নাড়া দিলেই যেনো পাউ- ঝরে পড়ে। কিন্তু এখানে এসে তাদের সেই স্বপ্নভঙ্গ। চরম হতাশা ও যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দিনযাপন করতে হচ্ছে।

রাতে মাথা গোজার ঠাঁই নেই। রেস্টুরেন্টে একটু আধটু কাজ করলে দু’বেলা খাওয়া আর রাতে একটু মাথাগোজার ঠাই ছিলো এতদিন। কিন্তু এখন কোনো কিছুই নেই। কারণ ইমিগ্রান্টস বিতাড়নে সরকার খড়গহস্ত। রেস্টুরেন্ট মালিক ঘুম থেকে জেগে পত্রিকা খুলেই দেখেন নতুন আইন। টিভি অন করলেই দেখতে পারেন ইউকেবিএ’র সাঁড়াশি অভিযান। অবৈধ অভিবাসীকে কাজ দিলে শুধু ২০ হাজার পাউ- জরিমানাই নয়, সাথে আরো দুই বছরের জেল। এতো ঝুঁকি নিয়ে কে কাজ দেবে? কোথায় যাবে তারা। রাতে থাকবেন কোথায়। দু’বেলা খাওয়ার যোগান দেবে কে? কেউ নেই ওদের পাশে।

মালয়েশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের দুরবস্থা নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হয়, কিন্তু বৃটেনপ্রবাসীদের নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কারণ এটি উন্নত দেশ। বিশ্বের রাজধানী। কাড়ি কাড়ি পাউন্ড আছে এখানে- এমন বিশ্বাস নিয়েই এদেশে আসা। একই বিশ্বাস নিয়েই স্বদেশে স্বজনদের গর্বের সাথে বেঁচে থাকা। কিন্তু কেউ কি শোনেছে তাদের বুকের ভেতরে জমেথাকা কষ্টের কাহিনী।

নাহ কেউ দেখেনি, কেউ শোনেওনি। রাতে ওদরে মাথা গোজার জায়গা নেই। পার্কের রেলিংয়ে মাথার নিচে হাত রেখে অনেককেই রাতযাপন করতে হয়। কখনোবা বাসে চড়ে লন্ডন শহরে ঘুরতে ঘুরতে নির্ঘুম রাত পার করতে হয় অবহেলিত এই মানুষদের। সকালে পাবলিক টয়লেটে হাত-মুখ ধুয়ে কোথাও কোনো দোকানে ঢুকে একপিস কেক কিংবা সিঙ্গাড়া খেয়ে নাস্তা সারতে হয়। পকেটে পয়সা নেই, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকে আর কত বিরক্ত করা যায়? ভিক্ষাবৃত্তি বেআইনী এই দেশে, নতুবা থালা নিয়ে বসতেও লজ্জা হতো না। এই হলো বিলেতের অবৈধ ইমিগ্রান্টের প্রকৃত জীবন কাহিনী। কিন্তু বাড়িতে স্বজনেরা জানে তিনি লন্ডনে আছেন, বেশ ভালোই আছেন।

উল্লেখ্য, অবৈধ অভিবাসীদের কাজ না দিতে ব্যবসায়ীদের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন ইমিগ্রেশন মিনিস্টার জেমস ব্রোকেনশায়ার। তিনি বলেছেন, একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী আছে, যারা বৃটিশ নাগরিকদের কাজ না দিয়ে বৃটেনে কাজের অনুমতি নেই এমন লোকদের কাজ দিয়ে বিভিন্নভাবে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। সন্দেহভাজন সেইসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে ইমিগ্রেশন অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অবৈধ ওয়ার্কারের খোঁজে ইমিগ্রেশন অফিসাররা ক্লিনিং কোম্পানী, বিভিন্ন বিলডিং সাইট এবং কেয়ার হোমসে অভিযান চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবৈধ অভিবাসী বিতাড়নে সরকারের সাথে একজোট প্রধান বিরোধীদল লেবার পার্টিও। লেবার নেতা ইভেট কুপার ইমিগ্রেশন মিনিস্টারের চেয়ে আরো একধাপ বাড়িয়ে বলেছেন, এ বিষয়ে হোম অফিসের আরো বেশি কিছু করা উচিত।

অবশ্য বিভিন্ন সময় বৃটিশ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ইমিগ্রান্টস কমিউনিটির পক্ষে কথা বলেছেন। গত বছরের নভেম্বরে কনফেডারেশন অব বৃটিশ ইন্ডাস্ট্রি সিবিআই’র বার্ষিক কনফারেন্সে সংগঠনের চেয়ারম্যান স্যার মাইক বলেন, এদেশের অর্থনীতিতে ইমিগ্রান্ট কমিউনিটির অবদান অনস্বীকার্য। ইমিগ্রান্টস কাজ বন্ধ করে দিলে দেশ অচল হয়ে যাবে, কারণ বৃটিশরা অলস। তারা কাজ করতে চান না। অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করে দেয়ার দাবী জানিয়ে ঐ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বৈধ করে দিলে তারা কাজ করতো, সরকারকে ট্যাক্স দিতো।

কিন্তু সরকারের একচোখা নীতি। যেকোনো মুল্যে ইমিগ্রান্টস তাড়াতে হবে। কিন্তু বোর্ডার নিয়ন্ত্রণ না করে এভাবেই কি ইমিগ্রান্ট কন্ট্রোল সম্ভব? আর সকল অবৈধ ইমিগ্রান্ট দেশ থেকে বের করে দিলেই কি বৃটেন উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাবে-এটাই বৃটিশ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের প্রশ্ন।

২০০৯ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস স্ট্যাডি এক রিপোর্টে জানিয়েছিলো, ইউকেতে প্রায় ৬ লাখ ১৮ হাজার অবৈধ বাসিন্দা রয়েছেন। আর ২০১০ সালে ক্যাম্পেইন গ্রুপ মাইগ্রেশন ওয়াচ জানিয়েছে ইউকেতে অবৈধ ইমিগ্রান্টের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশী অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা হবে প্রায় ৩ লাখ। অবৈধ অভিবাসীকে ধরতে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এইচএম রেভিনিউ এন্ড কাস্টমস, দ্যা গ্যাংমাস্টারস, লাইসেন্সিং অথরিটি ও হেলথ এন্ড সেইফটি এক্সিকিউটিভ যৌথভাবে অভিযান চালাবে। কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অবৈধকর্মী ধরতে পারলে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা এমপ্লয়ারকে ২০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করার আইন রয়েছে। পাশাপাশি জেনে শুনে কোনো অবৈধ বাসিন্দাকে কাজ দিলে এমপ্লয়ারকে দু’বছরের জেলদ- প্রদান করা হবে। সর্বশেষ গত মাসে অবৈধ অভিবাসীকে ঘরভাড়া দিলে ল্যান্ডলর্ডকে ৩ হাজার পাউন্ড জরিমানার আইন ঘোষণা করেছে সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.