আবু বকর সিদ্দিক::
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি ”
কবি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলাদেশ। পল্লি কবি জসীমউদ্দিন এর সোনার বাংলাদেশ। মাইকেল মধুসূদন এর বাংলাদেশ। আল মাহমুদের বাংলাদেশ। আরো শত শত প্রকৃতিপ্রেমী কবির বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ সত্যিই রূপসী কন্যা। ৫৬ হাজার বর্গমাইলব্যাপী শুধু সবুজের সমারোহ। নদী, পাহাড় আর গ্রামের সবুজের সংমিশ্রণে এক অন্য রকম বাংলাদেশ। এর প্রতিটি পরতে পরতে শুধু সোন্দর্য লুকায়িত আছে। তেমনি এক অবারিত সৌন্দর্য এর আধার সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর এ অবস্থিত রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট।
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট এর নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা রয়েছে। এর চারিদিকে শুধু পানি আর পানি আর পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সবুজের অভয়ারণ্য। একদিকে পানি তৈ তৈ করে আবার অন্যদিকে এর নানারকম বৃক্ষ। এ যেন এক অন্যরকম দৃশ্য। এ রকম দৃশ্য গ্রামে বন্যায় প্লাবিত হওয়ার সময় দেখা যায়। সবকিছু পানির উপর ভেসে উঠে।
গ্রামগুলো মনে হয় সবুজের আচ্ছাদনে ঘেরা। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট মনে হয় যেন কোন নির্জন দ্বীপ। এই দ্বীপের মধ্যখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গাছ আর গাছ। নৌকা করে যখন কেউ ঘুরাঘুরি করে তখন তার কাছে সেই দৃশ্যটা অপরূপ লাগে। এই বনে বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানাজাতের জলজ গাছ রয়েছে। এছাড়া সারা বন জুড়ে রয়েছে নানাজায়গায় বটগাছ। যা বনের লুকায়িত সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
রাতারগুল বনের অবস্থান সিলেট শহর থেকে ২৬ কি:মি দূরে। গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে গুয়াইন নদীর দক্ষিণে এই বনের অবস্থান। বনের দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি হাওর। রাতারগুলের টাওয়ার থেকে দূরের হাওয়ার দেখতে সত্যিই অসাধারণ মনে হয়। রাতারগুলের নামকরণ করা হয় সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটি গাছ নাম থেকে। সেই গাছের নাম থেকে এই বনের নাম রাখা হয় রাতারগুল। এ বনের আয়তন ৩, ৩২৫, ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর জায়গাকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। রাতারগুলে বর্ষা মৌসুমে পুরোপুরি পানি থাকে। যখন পুরো পানি থাকে তখন এর আসল সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়।
প্রকৃতি সিলেটকে তার দুহাত ভরে অপরূপ সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ভ্রমনপিপাসু মানুষের জন্য এক চমৎকার স্থান হচ্ছে সিলেট। সিলেটে প্রায় বারো মাস পর্যটনকদের ভিড় লেগেই থাকে। সিলেটে জাফলং, বিছনাকান্দি, পান্তুমাই, লালাখাল, খাসিয়া পল্লি, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হামহাম জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গল, লাউয়াছড়া চা বাগান সহ আরো অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে এই সিলেটে। বাংলাদেশ সরকার সিলেটকে পর্যটন নগরী বলে অভিহিত করেছিল কয়েকবছর আগে।
বিভিন্ন মিডিয়ায় রাতারগুলের বিচিত্র রমণীয় চিত্র দেখে ভ্রমণপিপাসু মানুষের ভিড় দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রায় মানুষ এখন রাতারগুল দেখতে আসে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে। অনেকে তাদের পরিবার নিয়েই এখানে আসে। পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর একটি চমৎকার জায়গা এই বন। বেশিরভাগ তরুণতরুণী এখানে আসেন প্রকৃতির এই অবারিত সুন্দরতা উপভোগ করার জন্য।
সিলেট শহর থেকে রাতারগুলে যাওয়ার জন্য দুইটি রাস্তা রয়েছে এয়ারপোর্ট রোড হয়ে যাওয়া যায় আবার হরিপুর এর রাস্তা দিয়েও রাতারগুল যাওয়া যায়। সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সিনএনজি করে সরাসরি রাতারগুল স্পটে যাওয়া যায় ভাড়া ৫০০ এর মত লাগে। আবার মাইক্রো করে যাওয়া যায় ভাড়া ২০০০-২৫০০ এর মত হয়। রাতারগুল স্পটে যাওয়ার পর সেখানে ডিঙি নৌকা পাওয়া যায় ভাড়া ৫০০ এর মত। সেখানে কোন মেশিনের শব্দ করে এমন ডিঙি ব্যবহার করা নিষেধ যাতে বনের পরিবেশ নষ্ট না হয়। এছাড়া সেখানে নীরবতা বজায় রাখা পর্যটকদের দায়িত্ব। বনের কোন ক্ষতি হয় এমন কোন এহেন কাজ করা উচিত নয়। এ পর্যন্ত অনেক প্রাণী বিলুপ্তপ্রায়। তাই পর্যটকমহল এর এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত।
আমি নিজেও একজন প্রকৃতি প্রেমী। সময় পেলেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। ঈদের পর কোন সুন্দর জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে হল। কোথায় যাওয়া যায় তা নিশ্চিত হতে সময় লাগছিল। পরে বন্ধু জিহাদের অনুরোধে তার বাড়ির পাশেই দেশের সেরা পর্যটক স্পট রাতারগুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। আমি আমার বন্ধু সুলতান, নাহিয়ান, সৌমিক, ইমতিয়াজ, ফারহান। আমরা মোট ছিলাম ৭ জন। সবার ঐকান্তিক ইচ্ছায় আর কষ্টে খুব কম সময়ে সম্ভব হয়েছিল এরকম একটি আয়োজন করা। জুনের ৩০ তারিখ খুব সকাল আম্বরখানা থেকে গাড়ি নিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম বিশ্বের ২২ টি সোয়াম্প ফরেস্টের একটি বাংলাদেশের আমাজন খ্যাত রাতারগুলের পথে।
১ ঘন্টা ২০ মিনিটের গাড়ি জার্নির পর আমরা পৌছে গেলাম রাতারগুল স্পটে। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়ালাম এই অনিন্দ্যসুন্দর এই জায়গায়। নৌকায় করে ঘোরাঘুরি করার সময় মনে হয়েছিল আমরা ইতালির ভেনিস শহরে এসে গেছি সেখানেও এমন করে নৌকা দিয়ে ঘুরাঘুরি করেন ভ্রমনপিপাসু মানুষেরা। আমরা প্রায় ১ ঘন্টা আড্ড, গান আর নানা খোশ গল্প করে শেষে ফিরে এলাম রাতারগুলের অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য ফেলে। দুপুরের খাবার জিহাদের বাড়িতেই শেষ করেই আমরা ফিরলাম কর্মব্যস্ত নগর জীবনে। পিছনে রেখে এলাম রূপসী রাতারগুল!আমাদের গাড়ি যখন হুহু করে সামনের দিকে আসছিল আমার তখন রাতারগুলের লোভনীয় দৃশ্যগুলোর চিত্র চোখের সামনে ভেসে আসছিল।
দেখে এলাম প্রকৃতির অপার রূপসজ্জায় সজ্জিত বাংলার আমাজন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। প্রকৃতি প্রেমীরা আমাদের মত একটু অবকাশ পেলেই ঢুঁ মারবে রাতারগুলের এই রূপসীকন্যার তীরে এটাই আমার একান্ত কামনা।
লেখকঃ শিক্ষার্থী ও প্রাবন্ধিক।