স্বপ্ন-গন্তব্যের মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের প্রত্যাশা


এম. নজরুল ইসলাম

বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় দিন ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। দীর্ঘ পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা কোনোভাবেই বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসনভার দিতে রাজি হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতকে তারা শুধু উপেক্ষাই করেনি, পচিশে মার্চ রাতে নরপশুরা ঘুমিয়ে থাকা নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ট্যাংক, কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঢাকা শহরে বয়েছিল রক্তের বন্যা। প্রস্তুত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই ওয়ারলেস ও বেতারযন্ত্রে প্রচারিত হলো বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। পাকবাহিনীর নিষ্ঠুরতার চিত্র তুলে ধরে সমগ্র জাতিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহŸান জানালেন। তার আগে ৭ই মার্চের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরপর দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দুঃখের বিষয়, তখন এই দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার হাত মিলিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। গড়ে তুলেছিল রাজাকার-আল বদর-আল শামসসহ বিভিন্ন নামের বাহিনী, যাদের অত্যাচার-নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাসের সব বর্বরতাকে হার মানিয়ে দিয়েছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থন, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালিদের পৌঁছে দেয় তাদের স্বপ্নের গন্তব্যÑমাহেন্দ্রক্ষণ বর্ষ ১৯৭১ সালে।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্তে¡ও পাকিস্তানি শাসকরা আওয়ামী লীগ নেতা, বাঙালির নয়নমনি বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শুরু করে বহুমুখী ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালিরা মহাবিক্রমে জেগে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃতে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করে।
দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে ঘুমন্তÑনিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারণাস্ত্রে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্তলোলুপ পিশাচেরা। নির্বিচারে তারা হত্যা করে অগণিত মানুষকে। ইতিহাসের এই বর্বরতম গণহত্যা বাঙালিদের স্তব্ধ করতে পারেনি। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে ওঠে তারা।
২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার অল্প সময় আগেই তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয়ে যায় ইপিআরের ওয়্যারলেসযোগে। ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটা হয়তো-বা আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহŸান জানাচ্ছিÑআপনারা যে যেখানে আছেন এবং আপনাদের হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হওয়া এবং চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্তু আপনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। খোদা হাফেজÑজয় বাংলা।’ ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১৫ মিনিটে স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়্যারলেস মেসেজ চট্রগ্রামে পৌঁছায়। তারপর চট্রগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম প্রচার করেন চট্রগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এম এন এ এম. এ. হান্নান। পরদিন ২৭ মার্চ, সন্ধ্যা ৭টায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৬ খন্ডের দলিল, মেজর সিদ্দিক সালিকের (১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর দায়িত্বে নিয়োজিত পাক সেনাবাহিনীর গণসংযোগ কর্মকর্তা) ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার এটাই প্রেক্ষাপট।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় ঘুরে দাঁড়ায় বাঙালি। ২৪ বছরের একটা অহিংস, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। তারা সারা দেশে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অদম্য মনোবল আর বুকভরা সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়ায় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে। তারপর দীর্ঘ ৯ মাসের মরণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চ‚ড়ান্তু বিজয়। ঐতিহাসিক এই বিজয়ের গৌরব-গাঁথার পাশাপাশি স্বজন হারানোর বেদনা এবং শোকের বিস্তৃতিও পাহাড়সম। ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হলো, ২ লাখেরও অধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারালো। প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। নৃশংস এইসব বর্বরতাও বাঙালিদের দমাতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে ১ লাখ সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল এ. কে. নিয়াজী। এমনি করেই শেষ পর্যন্তু অভ্যুদয় ঘটলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। হঠাৎ করে মেজর জিয়া নামের ব্যক্তিটির ঘোষণায় স্বাধীনতা আসেনি। যিনি ২৫ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাস করতে উদ্যত হয়েছিলেন, তার হঠাৎ করে কয়েক ঘন্টায় দীর্ঘ ২৪ বছরের একটা সংগ্রামের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার কোনও অধিকার ছিল কি? ‘সোয়াত’ জাহাজ হতে অস্ত্র নামাতে বিরত করা হয়েছিল বলেই জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ ছিল তাঁর জন্য বাধ্যবাধকতা, কারণ জিয়ার পক্ষে তখন হানাদার-বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করা সম্ভব ছিল না। জীবন বাঁচাতে পারবেন না বলেই তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। জিয়া তার অবস্থান সম্পর্কে ভাল করেই জানতেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি নিজে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেননি বরং সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ও জাতির জনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জে. জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা ওই ঘোষণার ব্যাপারটা নিয়ে ইতিহাস বিকৃত করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, ভন্ড, স্বার্থপর ও অনুগ্রহ-প্রত্যাশী বুদ্ধিজীবি এবং ক্ষমতালিপ্সু আমলা, রাজনৈতিক চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই স্বকপোলকল্পিত ইতিহাস তৈরির সিঁদেল চোরের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং বহু ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলাম। আজকের এই দিনে স্বাধীনতাযুদ্ধের সব শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যাঁরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানকারী সব ব্যক্তিকে। অন্যদিকে, আমরা ঘৃণা জানাচ্ছি পাকিস্তান বাহিনীকে সহযোগিতাকারী এই দেশেরই কিছু কুসন্তানকে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পরও স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। দেশ চলে যায় স্বাধীনতাবিরোধীদের কব্জায়। একাত্তরের ঘাতকরা ফিরে আসে রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশকে পুনরায় পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা চলে।
জাতি আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাধীনতা ৪৮তম বার্ষিকী উদ্যাপন করছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। একই সঙ্গে জাতিকে আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে দ্বিধাহীন চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সব অপশক্তিকে নির্মূল করার ব্যাপারেও। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, দেশরতœ শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব সভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। দেশের অর্থনীতির চাকায় গতি এসেছে। উন্নত বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল আজ বাংলাদেশ। দেশ পরিচালনায় তাঁর অগ্রসরমান চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটুক আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাক- এটাই আজ সবার প্রত্যাশা।

লেখক: সভাপতি, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ এবং
অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী ও লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.