নিরপরাধ মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মিয়ানমারের বৌদ্ধরা এ কোন সেবা করছে?

[author image=”https://scontent-sin6-1.xx.fbcdn.net/v/t1.0-9/10999104_1399790226996856_5764739570003812958_n.jpg?oh=d64224091f9e401861edc66852b12a48&oe=58C05F0E” ]খন্দকার জামিল আবেদ[/author]

qr-sdaf

খন্দকার জামিল আবেদ: বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বঞ্চিত-নির্যাতিত মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের অভিহিত করা হয়। যৌক্তিক কারণেই এমনটা বলা হয়। মিয়ানমারে রাষ্ট্র স্বীকৃত ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু সেখানেও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়নি। নেই তাঁদের নাগরিক স্বীকৃতিও। আবেদন করেও সরকার থেকে বরাবরই প্রত্যাখ্যাত।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বার্মা শাসন করছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। আর এর ফলেই তারা রোহিঙ্গা, চীনা জনগোষ্ঠী যেমন – কোকাং, পানথাইদের (চীনা মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে ব্যপকভাবে নির্যাতন করে থাকে।

বার্মার সরকার রোহিঙ্গা ও চীনা জনগোষ্ঠীর মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দিয়ে থাকে এবং এ কাজ তারা অতি সফলতার সাথেই করে যাচ্ছে।

কয়েক দশক ধরে এসব মুসলমান লোকেরা কোনো ধরনের আইনি বা অন্য যেকোনো ধরনের সুরক্ষা ছাড়া অবর্ণনীয় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

রোহিঙ্গারা কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠী রাখাইনদের বিষাক্ত আক্রমণের শিকার। বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠী রাখাইন কর্তৃক এমন বর্বরতার শিকার হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় কারনটি হচ্ছে তাদের দৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের কেবল মাত্র একটিই পরিচয়- রোহিঙ্গারা না মানুষ, না রোহিঙ্গা, তারা শুধুই মুসলিম। রোহিঙ্গারা শুধু আমাদের কাছেই শুধু মাত্র মুসলিম হিসেবে পরিচিত নয় জাতিসংঘ,আরব সংঘ সহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নিকটও তাদের কেবল একটিই পরিচয় ‘তারা মুসলিম’। তার প্রমান এই সকল স্বার্থবাদী সংগঠন ও বিশ্ব নেতাদের নিরবতা।

রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিকজনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। বর্তমান প্রায় ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করে। মায়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫ লাখ আরবে বাস করে বলে ধারনা করা হয় যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।15027981_160923483d
তবে ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।

এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। আমাদের ‘প্রাক্তন প্রভুরা’ মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের কত যে গোলমাল করে গেছে ব্রিটিশরা!

১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বার্মিজদের গ্রেফতার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। বার্মার শোষকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপূরী। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত “বার্মা সাম্রাজ্য”তে ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চিজ বুচানন-হ্যামিল্টন উল্লেখ করেন, “মুহাম্মদ(সঃ) – এর অনুসারীরা”, যারা অনেকদিন ধরে আরাকানে বাস করছে, তাদেরকে “রুইঙ্গা” বা “আরাকানের অধিবাসী” বলা হয়।

সন ১৯৪২ ২৮শে মার্চ, মায়ানমারের মিনবিয়া এবং ম্রক-ইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং কারেইনপন্থীরা প্রায় ৫,০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। এছাড়াও, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০,০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এতে উপ-কমিশনার ইউ য়ু কিয়াও খায়াং-ও নিহত হন যিনি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্হ বার্মায় আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ব্রিটিশপন্হীদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানীদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্হী অস্ত্রধারী মুসলমানদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানী শক্তির বিরোধিতা করেছিল, পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে।

জাপানীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল।এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে গিয়েছিল।15078733_10202690932992059_2639972379798418147_n

জাপানী এবং বার্মাদের দ্বারা বারংবার গণহত্যারশিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা স্হায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।

মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।

সিত্তের মতো অন্যান্য রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে রাখাইন শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের শালীন জীবন-যাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। লম্বা তারের বেড়া দিয়ে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
এক রোহিঙ্গা বলেন, সিত্তেতে তাঁর ভালো ট্যাক্সি ব্যবসা ছিল। এখন তাঁর লাভ কমে এক-তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের অনেকেই কৃষক বা মৎস্যজীবী। কৃষকেরা তাঁদের জমিতে নামতে পারছে না। অল্প কয়েকটি যে নৌকা রোহিঙ্গাদের রয়েছে, তা নিয়ে সাগরে নামলে রাখাইনেরা তাড়িয়ে বেড়ায়।15135787_1846457292256130_1009905440068502784_n

স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, জোর করে এমন বিচ্ছিন্ন করে রাখায় বরং রোহিঙ্গাদেরই লাভ হচ্ছে। এতে তাঁরা পরবর্তী আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের চোখে, এটি জাতিবিদ্বেষের দীর্ঘস্থায়ী একটি চরম নীতি। জীবন-যাপনের ন্যূনতম সুযোগ বঞ্চিত করার একটি প্রয়াস মাত্র।

গত তিন বছরে সিত্তে থেকে কোনো শিক্ষার্থী মিয়ানমারের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। মরার মতো অবস্থা না হলে শহরের হাসপাতালে তাঁদের প্রবেশাধিকার নেই।
সামরিক জান্তার পর ২০১১ সালে আধা বেসামরিক শাসনকালে মিয়ানমারের মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের বদল তো হয়ই নি, বরং আরও খারাপ হয়েছে। গত ২০১৪ সালে মিয়ানমারে আদমশুমারি হয়। গত শুক্রবার আদমশুমারির তথ্য প্রকাশ করে মিয়ানমার সরকার। সরকারের তথ্যে, দেশটির জনসংখ্যা পাঁচ কোটি ১৫ লাখ। কিন্তু সেখানে ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়নি। কারণ, আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের কেবল ‘বাঙালি’ হিসেবে নাম নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে রোহিঙ্গারা ওই আদমশুমারি বয়কট করে।

গত বছরের নভেম্বরে গত ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নির্বাচন হয়। অং সাং সু কি’র দলের জিতে নেয়া এ নির্বাচনের আগেই সেখানে রোহিঙ্গারা যেন প্রার্থী হতে না পারে, সে ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করা হয়।
মিয়ানমার সরকার দেশের মানুষের মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষ হিস্টিরিয়ার মতো তড়িত সংক্রমন আকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেনাবাহিনী আর ক্ষমতাসীন দল অত্যন্ত হিসাব করে লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের বঞ্চিত করছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু আর বৌদ্ধ বর্মীরা এ কাজে সরকারকে মদদ যোগাচ্ছে।

বৌদ্ধ কট্টরপন্থীদের ধারণা ছিল, রোহিঙ্গারা ভোটাধিকার পেলে এতে বিরোধী দল অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি পার্টি লাভবান হবে। মানবাধিকার আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সু চি নিরলসভাবে আন্দোলন চালিয়েছেন। কিন্তু সেই সু চিও রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়াননি। সু চির এমন অবস্থানে অনেকেই হতাশ হয়েছেন।

অভিবাসন প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নাটকীয়ভাবে নিরব রয়েছেন সু চি। সু চির এমন অবস্থানের কারণে দালাইলামা তাঁকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে বলার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু তাতে তখনও সু চির মুখের কুলুপ খোলেনি; কারণ তাঁর মাথায় ছিল নভেম্বরের ভোটের হিসাব-নিকাশ। রোহিঙ্গাদের পক্ষে বললে, বেজায় চটবে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা। তাতে তাঁর লাভের চেয়ে লোকসানটাই বেশি হবে।

সু চির নীরবতা অনেকটাই মিয়ানমার সরকারকে মৌন সমর্থন যুগিয়েছে। মিয়ানমার সরকার সাগরে ভাসা অভিবাসী সমস্যাকে সহজেই এড়িয়েছে। দাপ্তরিকভাবে রোহিঙ্গারা ‘নাগরিক’ নয় বলে তাঁদের দেখভালের দায়িত্ব সরকারের নয় বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
নভেম্বরে নির্বাচন শেষ হয়েছে। নতুন সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের বুক ফাটা কান্না থামে নি, বরং কেন বেড়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই।

সবার উপরে মানুষ সত্য, শুধুমাত্র রোহিঙ্গা মুসলিমদের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়।
ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, আদর্শ যার যার, মানবসত্তাই একজন মানুষের সর্বোচ্চ পরিচয়। বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের এমন কথার বুলিতে আজ তারাই প্রশ্নবিদ্ধ !

পৃথিবীর সবকটি ধর্মেই মানব সেবা প্রধান্য পেয়েছে। প্রশ্ন হল, বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, নিরপরাধ শিশু, নারী, যুবক, বৃদ্ধদের নির্বিচারে জ্যান্ত পুড়িয়ে তারা এ কোন সেবা করছে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.