লন্ডনে শফিক রেহমানের ৮৩ তম জন্মদিন ও না বলা অনেক কথা!

রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুর প্রেম ও প্রকৃতি এবং দার্শনিকতার পাশাপাশি শিখিয়েছেন কাদম্বীরির সাথে পরকীয়া, নজরুল শিখিয়েছেন সংসার, শরৎচন্দ্র শিখিয়েছেন কুসংস্কার, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফরা শিখিয়েছেন নাস্তিকতা, তসলিমা নাসরিন শিখিয়েছেন পুরুষ বিদ্ধেষ, আর যৌন সুরসুরী, আব্দুল গাফফার চৌধুরী শুনিয়েছেন ভাষার গান , আর শফিক রেহামান শিখিয়েছেন ভালোবাসা, ভালোবাসা, আর ভালোবাসা।

প্রিয় পাঠক গত বোববার ১২ ই নভেম্বর লন্ডনে চ্যানেল আইর ষ্টুডিওতে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক যায়যায়দিন এর সম্পাদক, লেখক, লাল গোলাপ খ্যাত উপস্থাপক শফিক রেহমান ও তার সহধর্মিনী তালেয়া রহমানকে। চ্যানেল আইর পক্ষ থেকে এর আগেও একুশে গানের রচিয়তা আব্দুল গাফফার চৌধুরীর জন্ম বার্ষিকী পালন করা হয়েছিল। বিবিসি খ্যাত সাংবাদিক সিরজুর রহমান সাহেবের জন্মদিন পালন করা হয়নি। তার আগেই তিনি চলে যান সব কিছুর উর্ধ্বে। এবার বাংলাদেশে জেল থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে আসলেন শফিক রেহমান। যারা লন্ডনে শফিক রেহমান মুক্তি আন্দোলন করেছিলেন তাদেরই একজন হচ্ছেন সাবেক রাষ্টপতি ইয়াজ উদ্দিন সাহেবের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারী জনাব শামসুল আলম লিটন। লিটন ভাইকে প্রস্তাব দিলাম শফিক রেহমান সাহেবের জন্মদিন চ্যনেল আই লন্ডন ষ্টুডিওতে লাইভ উদযাপন করা হবে। আপনি কথা বলেন। লিটন ভাই কথা বললেন, শফিক রেহমান সাহেব রাজী হলেন, তবে শর্ত দিলেন কোনো ভাবেই রাজনীতির কোনো কথা বলা যাবেনা, কোনো কিছু জিজ্ঞাস করা যাবেনা। আমি রাজী হলাম, মনে মনে বললাম, ষ্টুডিওতে চলে আসলে লাইভ প্রোগ্রামে বসলে তখন দেখা যাবে। কিন্তু না হলোনা পরিস্কার না করে দিলেন শফিক ভাই। ষ্টুডিওতে ঢুকেই তিনি কিছুটা অবাক হয়েছিলেন, কারন গনমানুষের কবি দিলওয়ারের কবিতা ছিল ষ্টেইজের সামনে, লেখা ছিল “যতদিন বেঁচো আছো মুক্ত হয়ে বাঁচো, আকাশ ও মাটির কন্ঠে শুনি যেন তুমি বেঁচো আছো।

কবিতার লাইনের সাথে শফিক রেহমান সাহেবের জীবনের কোনো মিল নেই। তিনি যে দেশে জন্ম নিয়েছিলেন তার প্রিয় বাংলাদেশ তাকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকতে দেয়নি। বার বার তিনি হোঁচট খেয়েছেন। দেশ থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে তাকে, এরশাদ সাহেব তাকে বার বার দেশ থেকে বিতাড়িত করেছেন। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন লন্ডনে। শফিক রেহমান মুক্তমনা মানুষ সন্দেহ নেই। মুক্তভাবে তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন! তিনি কি পেরেছেন?? লন্ডনে তিনি বসে ছিলেননা। ১৯৯১ ইংরেজীতে তিনি প্রতিষ্টা করেছিলেন বাংলা ভাষায় রেডিও। রেডিও স্পেকট্রাম। তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার সেটির উদ্বোধন করেছিলেন। শফিক রেহমান সাহেব এক সময় স্পেকট্রাম ছেড়ে দেশে চলে গিয়েছিলেন। এরাশাদ সাহেবের শাসনামালে যায়যায়দিন নামক সাপ্তাহিকটি তখন ছিল উঠতি বয়সি তরুনদের সারা সপ্তাহের খোঁড়াক। আমার মত অনেক তরুনরা সেটি পড়তো। যায়যায়েদিনে তিনি কলাম লিখতেন। দিনের পর দিন। মিলার সাথে প্রেম করে করে তিনি এমন সব সিরিয়াস কথা লিখতেন যা ছিল আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। আমার মনে আছে এক সময় শফিক রেহমান সাহেবের লেখার জবাব দিয়েছিলেন তারই ঘনিষ্ট বন্ধু আব্দুল গাফফার চৌধুরী, গাফফার ভাই লিখেছিলেন আমার বন্ধু শফিক রেহমান মিলার সাথে প্রেম করে করে লিখেন, কিন্তু যৌবন তার কবে পশ্চিম দিকে হেলান দিয়ে পড়ে আছে, আমরা সেদিন এ লেখাটি পড়ে অনেকটা মজা পেয়েছিলাম।

সেই শফিক রেহমান সাহেবের জন্মদিন পালনে আমি উপস্থাপাক। আমাকে বললেন কোনো রাজনৈতিক কথা বলতে পারবেনা। আমি শফিক ভাইর কথা মেনে নিলাম। তিনি বলছেন তো বলছেন, জোকস বলছেন আমরা শুনছিলাম। তিনি তার লালগোলাপ শুভেচ্ছা দিয়েছেন লন্ডনে চ্যানেল আইর দর্শকদের। তার স্ত্রী তালেয়া রহমান মাঝে মধ্যে কথা বলেছেন। এক সময শফিক ভাই জেলে পুলিশের সাথে জোকের কথা বলে অনেকটা আবেগ প্রবন হয়ে পড়েন। আমি পাশে বসে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরন বুঝতে পেরেছিলাম। শফিক ভাই খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন তাকে জেলে নেয়ার পর তা ও আবার রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল তাকে। একজন ৮৩ বছরের লোককে জেলে নিয়ে গিয়ে কি এচিভ করলো সরকারের কর্তা ব্যাক্তিরা আমি বুঝিনা। শফিক ভাই বঙ্গববন্ধুর কোলে পিঠে মানুষ হয়েছেন সেটিও বলেছেন, তার বাবা অধ্যাপাক সাঈদুর রহমান সাহেব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সরাসরি ছাত্র ছিলেন সেটিও বলেছেন। আমাদেরকে বুঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে শফিক রেহমান সাহেবের পারিবারিক সম্পর্কটির কোনো শিরোনাম নেই, হয়তো অদৃশ্য এক বন্ধন তাদের মধ্যে ছিল, সে সম্পকটি কি অপূর্ণ থেকে গেছে সারাজীবন?। সাঈদুর রহমান সাহেব প্রায় দশহাজার লোকের বিয়ে দিয়েছেন তাও বলতে ভুলেননি, তবে শফিক রেহমান সাহেবের বিয়ের কথা জানতেননা তার বাবা সাঈদুর রহমান এটি নিয়ে তার কিছুটা হলেও দুঃখবোধ আমি লক্ষ করেছি। তিনি তালেয়া রহমান কে বিয়ে করেছেন প্রেম করে। এক সাথে পড়া লেখা করেছেন তার স্ত্রীর সাথে, তাদের বিয়ের ৬৫ বছর অতিক্রম করেছে। স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসেন শফিক রেহমান তা বুঝা গেল তার কথায়। জেলে যাওয়ার পর থেকে জন্মদিন পালন পর্যন্ত শফিক রেহমান হেঁসে কথা বলেননি। জন্মদিনে এসে তিনি খুবই খুশী হয়েছেন, আনন্দিত হয়েছেন এটি আমাকে বলেছেন তালেয়া রেহমান। জেলে যাওয়ার পর থেকে তিনি কেন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন আমি জানিনা। কে একজন বলেছিল “পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী প্রতিশোধ হলো নিশ্চুপ থাকা। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকাটা কি উচিৎ? শফিক ভাই হয়তো এ বয়সে আর রিমান্ডে যেতে চাননা। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় শফিক ভাই প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন সরকারকে। এভাবে ভয় পাওয়া কি উচিৎ? আমি জানিনা। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকনা কেন জুলম নির্যাতন কারাবাস পুলিশি হয়রানী কি বাঙালীদের ললাট লিখন? এ থেকে বাংলাদেশ কবে বের হবে? গত ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশ আঠকে আছে দু মহিলার প্রতিহিংসার রাজনীতির কাছে। প্রতিহিংসার আগুনে জলছে দেশের মানুষ। ইদানিং নতুন করে শুরু হয়েছে খুন আর সেই সাথে গুম। সেদিন আমার এক পাঠক ফোন করে বলেছেন ভাই আপনারা যারা মিডিয়া চালান আপনারা তো গুমের ব্যাপারে কিছুই বলছেননা। এ গুম কেন? বাংলাদেশ তো অতীতও চলেছে, তখন তো গুম ছিলনা।

আমি জানি বাংলাদেশ ক্রমেই ধ্বংসের দিকে এগুচ্ছে। রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি একটি দেশের দিনের পর দিন ভঁঙ্গুর থাকতে পারেনা। অনেকে ইন্ডিয়ার দোষ দেন? ইন্ডিয়া কি বলে দেয় গুম করে ফেলতে? কিছু হলেই ইন্ডিয়া। আমাদের রাজনীতিবীদদের দোষ আছে। এতটা প্রতিহিংসাপরায়ন হয় কি করে মানুষ। একজনের মতের সাথে অমিল থাকতেই পারে, তাই বলে কি তাকে খুন করে ফেলতে হবে? তাই বলে কি তাকে গুম করে ফেলতে হবে। লাগাম ছাড়া কথা বার্তা বলে শত্রু সৃষ্টি হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না।

সে যাক, যে শফিক রেহমান দিনের পর দিন কলামে রাজনীতির কথা লিখেছেন সেই শফিক রেহমান জীবনের সন্ধ্যাবেলায় এসে কেন তিনি রাজনীতি থেকে দুরে সরে গেলেন? কি কাজ করেছে সেখানে? আমি যতটুকু শুনেছি তিনি জেল থেকে বের হওয়ার সময় নাকি একটি দেশের গোয়েন্দা সংন্থা কথা বলেছে, যদি তা সত্যি হয় তাহলে শফিক রেহমান সাহেবের উচিৎ তা জাতীর সামনে তুলে ধরা। যে যতই বলুক নিশ্চুপ থাকাটা একটি প্রতিশোধ। আমি সেটি কোনোভাবেই মানতে পারিনা। আমাকে একজন কষে থাঁপ্পর দিল, আমি বসে বসে সেটি সহ্য করবো তা তো হয়না।

সমালোচকরা বলেন শফিক রেহমান সাহেব বিএনপিতে সরাসরি যোগ দিয়ে জীবনে মস্ত বড় ভুল করেছেন। আমি সেটি বিশ্বাস করিনা। জীবন অনেককেই ভুল পথে নিয়ে যায়। ঠিক জীবন নয়, সময়। সময়ের কাছে মানুষ অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে। জীবন বা সময় যতই মানুষকে ভূল পথে নিয়ে যাকনা কেন জীবনকে সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব কার? মানুষেরই। মানুষ জীবনকে পরিচালিত করে! জীবন মানুষকে পরিচালিত করেনা।

প্রিয় পাঠক লেখার শুরুতেই যে সব কবি সাহিত্যিকদের নাম নিয়ে কথা বলেছি, অনেকে বলেন তারা সমাজকে দিয়েছেন অনেক। আমার কেন জানি তা মনে হয়না। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাকে যতটা না কুলষিত করেছেন আমাদের অনেক গন্ডমূর্খ রাজনীতিবীদরা, তারচাইতে বেশী কুলষিত করেছেন এ সব লেখক কবি সাহিত্যিকরা। ওরা জীবনে যশ আর খ্যাতি পাওয়ার জন্য মানুষের ধর্মকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এই ট্রেডিশনটা কিন্তু ভারত উপমহাদেশে। বৃটেনে আছি আজ ২৭ বছর। কিন্তু খুব কম ই লেখক সাহিত্যিক কবি ধর্মকে নিয়ে ঠেনা হেঁচড়া করে। বৃটেনের চার্চে এখন মানুষ আর যায়না। চার্চ এখন বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে, আর সে সব চার্চ ক্রয় করছেন মুসলমানরা, মুসলমানরা ক্রয় করে ই ক্ষান্ত না, তারা চার্চ ক্রয় করে মসজিদ তৈরী করছেন। আপনি চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন বাংলাদেশে কোনো মসজিদ বিক্রি করে যদি হিন্দুদের উপসানালয় তৈরী করে তাহলে কি হবে অবস্থা?? আমি আর চিন্তা করতে পারিনা পাঠক। আমার চিন্তার মধ্যে শফিক রেহমান সাহেবের মায়াবী মুখখানি ভেঁসে উঠে। যার শ্লোগান হচ্ছে ভালোবসা আর ভালোবাসা। শফিক রেহমান ধর্মকে নিয়ে ঠানা হেঁচড়া করেননি, তিনি বলেছেন একজন অরেকজনকে ভালোবাসো। বাংলাদেশে এ হানা হানি না করে ভালোবাসা আর পারস্পারিক সম্প্রীতি গড়ে তুলা যায়না? আমি জানিনা। আমার এক সাবেক প্রেমিকার চিঁঠির কথা মনে পড়ে। ৮০ দশকের শেষ দিকে অমার সেই প্রেমিকা লিখেছিল প্রিয় ফয়সল চৌধুরী শোয়েব ভালোবাসি ভালোবাসবো থামিনা থামবনা, কত যে ভালোবাসি তোমাকে তা বুঝাতে পারবোনা ;;;;;;;

লন্ডন, ১৮/১১/২০১৭

লেখক সভাপতি ইউকে বাংলা প্রেস ক্লাব

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি বাংলা ষ্টেটমেন্ট ডট কম

ব্যবস্থাপনা পরিচালক চ্যানেল আই ইউরোপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.